ফোনটা হাতে নিয়ে কন্ট্যাক্টলিস্টে শুধু একটা নামকে দেখেই সময় কাটে অমিতের। মানে যখন খুব একা লাগে, ও দেখেছে, নামটা দেখলেই ওর বেশ একটা ভাললাগতে শুরু করে। মাঝে মাঝে এরমটাও হয়েছে, নামটা দেখছে…আর ঐ নামটা থেকেই ফোন এসেছে। ফোনটা বেজে যায়…. হ্যাঁ, বেজে যায়, অমিত ফোনটা ধরে না …. চোখের সামনে বাজতে বাজতে ফোনটা থেমে যায়; অমিত বিধাতাকে ধন্যবাদ জানায়; ফোনটা আসে ….মাসে একবার, দুমাসে একবার, তিনমাসে একবার। আসে, বেজে যায়। কিন্তু আসবেই। সে এখনো মনে রাখে তাকে, ভোলে নি। অমিত জানে, ভুলবেও না।
************************************************
সবাই এসে গেছে, ঐ হতচ্ছাড়া গৌরবটার কোনও পাত্তা নেই। কি অসহ্য একটা রিংটোন রেখেছে … ফোন করলেই “ও টুনির মা” গানটা বাজে, উফ! বয়স যে বাড়ছে, তার কোনও বোধ আছে? ছেলে এদিকে উচ্চমাধ্যমিক দিতে চলল। ওকে ছাড়া ঠিক জমছেই না আড্ডাটা। কত চেষ্টার পর এই গেটটুগেদারটা অ্যারেন্জ করা গেছে, আর যে করল, তারই পাত্তা নেই। ডরথি আবার ফোন লাগাল গৌরবকে। রাত ন’টা, সবার পেটে অলরেডি দু পেগ পড়ে গেছে, এরপর তো সেই তাড়াহুড়ো লাগবে বাড়ি ফেরার জন্য। ডরথিকে বাড়ি পৌঁছে দেবার দায়িত্বটাও সেই নিয়েছে….
-কোথায় তুই?
-আরে, আসছি, আসছি, ৫ মিনিট
-বাজে বকিস না, কোথায় তুই ঠিক করে বল, লাস্ট পঁয়তাল্লিশ মিনিট ধরে বলে যাচ্ছিস ৫ মিনিটে আসছিস।
-না , না, এই বার সত্যি ৫ মিনিট, আরে কেসটা হয়েছে কি…
-কি?
-নাহ, এসেই বলছি…গড়িয়াহাট ক্রস করে ফেলেছি।
সৈকতের বউটা বেশ আলাপী। ওর সাথে গল্প করতে ভালো লাগছে, বাকিরা সব এতদিনপর….জড়তা কাটতে আরও এক-দুটো জমায়েত দরকার।
জয়ন্ত এসে থেকেই পলিটিক্যাল কথাবার্তা শুরু করেছে, খুব সহজেই আবহাওয়াটা বেশ নিন্দাপূর্ণ হয়ে উঠেছে। কোথায় এতদিন পর সব্বার দেখা হল, একটু পসিটিভ কথাবার্তা হোক; নবারুন ফাঁক পেলেই শেয়ারট্রেডিং এর জ্ঞান দিচ্ছে, অনুমিতা ও তার বর তো নিজেরা নিজেকেই নিয়ে ব্যাস্ত।
অর্পণ বারান্দায় একা একা সিগারেট খাচ্ছিল, দেখে, ডরথি গেল তার কাছে।
– তুই আর বিয়ে করবি না?
– দরকার নেই তো।
– বাজে বকিস না, কোনও বয়ফ্রেন্ড বানাসনি?
– প্রচুর।
– তাহলে তো ওকে।
– ওকে মানে?
– মানে কি বোঝাতে হবে এখন?
মানেটা ডরথি বুঝতে পারে, ওয়াশরুমে যাবার অজুহাতে চলে আসে। ব্যাটা গৌরব এত দেরী করে আসছে জানলে, ও নিজেও দেরী করে আসত। অবশ্য তাহলে তো ফ্ল্যাটটা খুলে সব আয়োজন কে করত…
খুব রাগ হচ্ছে গৌরবের উপর। পারেও বটে ছেলেটা। নিজে যেচে সব কলেজের বন্ধুদের নিয়ে হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপ করে এই জমায়েত প্ল্যান করেছে। প্রায় ১৫ বছর পর সবার দেখা, যারা বিদেশে আছে, তারা আসল না, আর অনির্বাণের মতন লোকজন তো মেলামেশা পছন্দ করে না, সব মিলে ১৪ জনের পার্টি আজ; আর দ্যাখো, পালের গোদারই দেখা নেই।
ডরথির নতুন ফ্ল্যাটের কথা শুনে সব্বাই দাবি করেছিল, এই ফ্ল্যাটেই হোক গেটটুগেদার। সকলের কতরকমের প্ল্যানের পর ঠিক হয়, ফাঁকা ফ্ল্যাটে চেয়ার টেবিল ভাড়া করে, খাবার আনিয়ে পার্টি হবে।
বেল বাজল। এটা গৌরব… এভাবে অসভ্যের মতন আর কেউ বেল বাজাতে পারে না। ঢুকেই শুরু গালাগালি, সত্যি ওর মতন আসর জমাতে খুব কম লোকই পারে। এতক্ষনে যেন মনে হচ্ছে, সত্যি আমরা সব পুরনো ছোটবেলাটা খুঁজে পাচ্ছি।
**************************************
স্বীকৃতি – ১
মিয়াঁও,
যা গরম পড়েছে, আমাদের মতন দেশে প্রতি গরমকালেই এইরকম উক্তি চতুর্দিকে শুনতে পাওয়া যায়….
লেখা শুরু করলাম এই ভেবে যে, এই বছর গরমকালটা বেশ স্পেশাল, কারণ… তোর ফোনটা;
বয়সটা বাড়ছে, রুপোলী ঝিলিক এসেছে মাথায়, আমার পেশাগত কারণে রোজই কোনও না কোনও নতুন ঘটনা ঘটতেই থাকে, তাই জীবনে একঘেয়েমিটা সত্যি নেই।
আজ তোর সাথে মিনিট দশেকের কথাটা আমার কাছে এক দারুন প্রাপ্তি, আজ যে কথা আমায় বললি….. আগে কেন এভাবে বলিস নি বলতো? তাহলে তো আমাদের দুজনের জীবনটা একদম অন্যরকম হতে পারত! হয়তঃ, তুই বলতে চেয়েছিলি, হয়তঃ বলেওছিলি, আমি বুঝি নি।বিশ্বাস কর, আজ ফোনে তোর প্রতিটা শব্দ আমায় ইথার তরঙ্গ বেয়ে ছুঁয়ে গেল।হয়তো, এটাই ঠিক সময়, স্বীকৃতির।
মেইল সাবজেক্ট এ নম্বর দিলাম, সিরিজটা চলুক, কি বল?রিপ্লাই পেলে, ভালো লাগবে।
তোর মাফিন।
মাফিন, কতদিন পর নামটা ডাকলাম। আমিও জানি না, কেন তোকে এসব বললাম; আমি বদলে গেছি রে। অনেক বদলে গেছি। তুই যাকে চিনতিস, আমি সে নই। তোকে মনে পড়ে, খুব মনে পড়ে। আমি জানি, পৃথিবীতে এই একজন আমায় মনে রাখবে, আর কেউ না রাখুক।
খুব ভালো লাগল এই স্বীকৃতি। অপেক্ষায় রইলাম পার্ট- ২ এর জন্য।
তোর মিয়াঁও
স্বীকৃতি – ২
প্রিয় পাঠক, স্বীকৃতি কিন্তু ভারি অভিমানী; আপনার অনুভূতি না জানলে, আর এগোবে না।তাই প্রতি পত্র আপনার উত্তরের অপেক্ষায় থাকবে।
মিয়াঁও রে, একটা নতুন উত্তেজনা স্নায়ুতন্ত্রে যুক্ত হয়েছে, আভাসটা যদিও প্রচ্ছন্ন; এই বয়সে প্রকটতাটা মারাত্মক।
অনেক ভুলে যাওয়া মুহূর্ত মনে পড়ছে।
৫ বছর পর, আমার দাম্পত্য শুকনো। দুজনেই ভীষণ নির্লিপ্ত। ভেতরে এক ভয়ঙ্কর ভালবাসাহীনতার হাহাকার জমে আছে …. বেশীর ভাগ সময়েই আমল দিই না।তবে মাঝে মাঝে চোখটা ভিজে যায়, এমনি এমনি।
তোরও সংসার আছে।
এই স্বীকৃতি যদি কোনও ভাঙনমূলক অবস্থার সৃষ্টি করে, থামিয়ে দিস।
মাফিন।
প্রিয় পাঠিকা,
ধন্যবাদ পার্ট–২ এর জন্য।
সারাদিন আইনের প্যাঁচ কষতে কষতে, ক্রিমিনাল ঘাঁটতে ঘাঁটতে নিজের অনুভূতিগুলোকে চিনতেই ভুলে গেছি রে। তোর মতন এমন সুন্দর শব্দবিন্যাসে লিখতে পারি না; যতটুকু বোঝাতে পারি, তা দিয়েই বলছি, আমি কোনও কথা এমনি এমনি বলি না, তুই আমার কাছে স্পেশাল, প্রেসিয়াস। ছিলি, এখনও আছিস, থাকবিও।
তোর এইরকম লেখা …আমার জন্য লেখা; ভেবেই ভালো লাগছে।
স্পন্ডিলাইসিসের ব্যাথাটা যখন বাড়ে, তোর লেখা পড়ি, ব্যাথা কমে যায়।
চালিয়ে যা লেখা, থামাস না।
নেক্সট কবে?
মিয়াঁও
স্বীকৃতি – ৩
হা হা হা হা
তাহলে, ডাক্তারিও করতে পারছি, কি বলিস?
আমার ফিজটা কি হবে?
মহাশয়, আপনার প্রশংসা পেয়ে আমি যারপরনাই আনন্দিত, আহ্লাদিত, বিগলিত চিত্ত। হা হা হা।
জীবনে রিজেকশানটা এত বেশী এসেছে যে, প্রাপ্তিগুলো মন ভরিয়ে দেয়।
আজ দিনটা ভারি সুন্দর। বৃষ্টি পড়ে সূর্যের চোখ রাঙ্গানিকে কমিয়েছে; অনেকটা আমার মনের খড়খড়ে জমিটাকে আলতো জলে ভেজানোর মতন।
টাচস্ক্রিনে প্রতিটা অক্ষর টাইপ করতে করতে ভাবছি, পারবে কি? এই শব্দগুলো কি জীবন্ত হতে পারবে? পারবে, স্ক্রিন ভেদ করে তোকে স্পর্শ করতে?
আদিখ্যেতা মনে হচ্ছে?
ছেলেমানুষ হয়ে পড়েছি। আবার সেই ছোটবেলায় ফিরে যেতে ইচ্ছে করছে।
বাদ দে। ভালো থাকিস।
মাফিন
মাফিন,
তোকে আজ একটা কথা জানাতে খুব ইচ্ছা করছে। অনেকদিন ধরে তোকে বলব ভেবেছি, বলে উঠতে পারি নি, সব সময় মনে হত, তুই কি ভাববি। তোকে যদি হারিয়ে ফেলি, এই ভয়টা আমায় অনেক কিছু করতে দেয় নি। খুব আফসোস হচ্ছে এখন।
একদিন তোর বাড়িতে পড়তে গেছি, সেদিন টিউশন শেষে সবাই বেরিয়ে গিয়েছিল, ঘরের মধ্যে তুই আর আমি, তুই সেদিন একটা হলুদ রঙের সালোয়ারকামিজ পরেছিলি, দারুন লাগছিলো তোকে। খুব ইচ্ছা করছিল, তোকে জড়িয়ে ধরতে। চুমু খেতে। ভয় পেয়েছিলাম, তোকে হারানোর ভয়।
কথাটা মাঝে মধ্যেই মনে পড়ে, বিশেষ করে যখন খুব একা লাগে।
আজ, কথাটা বলে ফেলে, খুব হাল্কা লাগছে নিজেকে। আর ভয় নেই তোকে হারাবার।
মিয়াঁও
স্বীকৃতি – ৪
তোর এই ভয়টা আমাদের দুজনের জীবনটাই বদলে দিল রে।
এই কদিনে যখনই সময় পেয়েছি, স্বীকৃতি খুলে পড়েছি। খুব ইনভল্ভড হয়ে পড়ছি রে। সবসময় তোর কথা মনে হচ্ছে, তোকে কাছে পেতে ইচ্ছে করছে।
ঠিক নয়, এগুলো ঠিক নয়।
বিয়েটা বেশীদিন আর টিকবে না, বুঝতে পারছি। মৈনাক আমায় বাড়ি ছেড়ে চলে যেতে বলেছে, কালকেই চলে যাচ্ছি। এখন কিছুদিন মায়ের কাছে থাকব। তারপর, ব্যাঙ্গালোর এ একটা কাজের কথা চলছে, শিফট করব।
মিয়াঁও, তোর এমন হচ্ছে না?
ভগবানের কাছে প্রার্থনা করি, এমন যেন না হয়।
তোর বউ তো চাকরিও করে না,
তুই ভালো থাক।
আমার কাছে তুই ডায়রির পাতা হয়েই থাকবি, তাতে দুজনেরই ভালো।
স্বীকৃতি হার স্বীকার করল।
এ ভাবে চলে যাস না মাফিন। আমি কি করে থাকব? আমি তোকে হারাতে চাই না মাফিন। প্লিজ।
********************************************
পার্টি শেষ হল রাত বারোটায়। সব কিছু গুছিয়ে বেরোতে বেরোতে প্রায় একটা।গৌরব ছিল বলে রক্ষে।
খাওয়াদাওয়ার পর ঘর মোছা কি চাট্টিখানি কথা। গা-হাত-পা প্রচন্ড ব্যাথা করছে। রাক্ষসগুলোর পেটে মাল পড়লেই আন্সিভিলাইসড হয়ে পড়ে, কি করে ফেলেছিল ফ্ল্যাটটাকে। গৌরবের গাড়িতে উঠেই সিটে এলিয়ে পড়ল ডরথি।
– তোকে বলেছিলাম, দু দিন পর একটা কাজের লোক দিয়ে ঘরটা পরিস্কার করলে হত না? কি পিটপিটে রে তুই? জীবনে তোর অশেষ দুঃখ, বলে দিলাম।
-বাজে কথা না বলে গাড়ি চালা। ভাগ্যিস কাল রোববার। সারাদিন ঘুমাব।
-তোর সাথে একটা কথা ছিল।
-বল
-আমার আজ কেন আসতে দেরী হল, শুনবি?
-আমার শুনে কি কোনও লাভ আছে?
-অমিতের সাথে দেখা হয়েছিল, লাস্ট স্টেজ।
ডরথির মুখ থেকে কথা সরে না। ব্যাঙ্গালোর গিয়ে কিছুদিন পরেই জানতে পেরেছিল অমিতের ক্যান্সার। খুব মনে হয়েছিল, দৌড়ে চলে যেতে ওর কাছে। ফোন ধরে নি অমিত। ডরথি বুঝেছিল, অমিতের জীবনে এই মুহূর্তে ওর প্রবেশ মানায় না।গৌরবের থেকে খবর জানতো অমিতের। কলকাতায় ফিরে আসার খবর ওই অমিতকে দিতে মানা করেছিল।
নিজেকে যখন বেসামাল লাগে, ফোন করে মিয়াঁওকে – ডরথির মিয়াঁও। ফোনটা বেজেই যায়…. বেজেই যায়।
ভীষণ ভাল লাগলো৷ পড়তে আরম্ভ করে শেষ না করে ছাড়তে পারলাম না৷ পড়তে পড়তে মনে নাড়া দিয়ে গেল–আমরা প্রত্যেকেই বোধ হয় একসময় মিয়াও – মাফিন ছিলাম৷আমার মধুরতম ইচ্ছা সহ —দিলীপ ঘোষ
অনেক ধন্যবাদ। উৎসাহ পেলাম। ভালো থাকবেন। উইশস্ক্রিপ্টের সাথে থাকবেন।
Darun likhechis❤️
ধন্যবাদ বন্ধু। সাথে থাকিস।
Make a more new posts please 🙂
___
Sanny